ইসিজি গ্রাফে থাকে পি, কিউ, আর, এস, টি নামের শীর্ষবিন্দু ও পাদবিন্দু। হার্ট অ্যাটাকের ক্ষেত্রে এই বিন্দুগুলিই অস্বাভাবিক উঁচু-নিচু হয়ে যায়, কখনও বা বেড়ে-কমে যায় তাদের মধ্যবর্তী ব্যবধান। বিগড়ে যাওয়া সেই গ্রাফ দেখে অনেক সময়ে হৃদরোগ চিহ্নিত করেন চিকিৎসকরা। বেশ কিছু দিন ধরেই তাঁদের পর্যবেক্ষণ, ইদানীং দেখা যাচ্ছে, হার্ট অ্যাটাক বা মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশনের যে সব ঘটনা ঘটছে, সেই সব রোগীদের অধিকাংশের ইসিজি-তেই এস এবং টি বিন্দু দু’টি খানিকটা উঁচু (এসটি এলিভেশন)। এবং এই সব রোগীরা মূলত মধ্যবয়সি ও কম বয়সি, যাঁদের কোনও ঝুঁকির ইতিহাসও ছিল না।
চিকিৎসকদের সন্দেহ, করোনার ছোবলেই হৃদযন্ত্রের এমন দশা জনসংখ্যার একটা বড় অংশের। তাঁরা জানাচ্ছেন, করোনার সংক্রমণ এবং পরবর্তী কালে লং কোভিডের প্রভাবেই অনেকের হৃদপেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যাকে বলে মায়োকার্ডাইটিস। সেটিই আচমকা বাড়িয়ে দিচ্ছে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি। এবং হচ্ছেও। সেই সব রোগীর ইসিজি রিপোর্টে এসটি এলিভেশন দেখা যাচ্ছে। তাই এ ধরনের মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশনকে (এমআই) বলা হয় এসটি-সেগমেন্ট এলিভেশন এমআই বা সংক্ষেপে, স্টেমি। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, কিছু দিন হলো এই স্টেমি-র নজির বেশ চোখে পড়ার মতো।
বিএম বিড়লা হার্ট হাসপাতালের প্রধান হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অঞ্জন সিওটিয়া বলছেন, ‘গত তিন মাসে স্টেমি কেসের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গিয়েছে। এমনটা যে কোনও বয়সেই হতে পারে। তবে দেখা যাচ্ছে, ৪০-৭০ বছর বয়সিরা এর সবচেয়ে বেশি শিকার।’ তিনি জানাচ্ছেন, গত তিন মাসে, এমন ৭০ জন রোগী তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন যাঁদের তাঁরা সুস্থ করে বাড়ি পাঠিয়েছেন। এঁদের ৬০ জনই ছিলেন পুরুষ। প্রত্যেকেই হৃদপেশি রক্ত চলাচল থেকে বঞ্চিত হওয়ার জেরে বুকে মারাত্মক যন্ত্রণা, চাপ ভাব এবং দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে এসেছিলেন।
কল্যাণীর গান্ধী মেমোরিয়াল হাসপাতালের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অর্ণব রায় বলেন, ‘স্টেমি আগেও পেতাম। কখনও-সখনও। কিন্তু এখন খুবই বেড়ে গিয়েছে। বিশেষ করে কম বয়সিদের মধ্যে, যাদের কখনও কোনও রিস্ক ফ্যাক্টরও ছিল না। ২৫-২৬ বছর বয়স, স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা। অথচ কোনও পূর্বলক্ষণ ছাড়াই হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে। আমার ধারণা, করোনাই ভিলেন।’ বিএম বিড়লার প্রবীণ হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ধীমান কাহালির তাই পরামর্শ- ‘এখন যে হারে কম বয়সে হার্ট অ্যাটাক বেড়ে গিয়েছে, তাতে আর ৪০ পেরোনোর পর নয়, বরং বয়স ২৫ পার করলেই ইসিজি-সহ কার্ডিও চেক-আপ করিয়ে নেওয়া ভালো। কোনও শারীরিক অসুবিধা না থাকলেও।’
একই সুর সল্টলেকের মণিপাল হাসপাতালের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ পার্থসারথি বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায়। তাঁর মতে, স্টেমি-র সংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়ে যাওয়ার নেপথ্যে করোনা ছাড়াও দৈনন্দিন অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রাও দায়ী- ‘জাঙ্ক ফুডের বাড়াবাড়ি, কায়িক পরিশ্রমের অভাব ঝুঁকিটা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। আর উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবিটিস বা ওবেসিটি থাকলে তো কথাই নেই!’ তিনি জানাচ্ছেন, সে জন্যই অতিমারী পরবর্তী সময়ে স্টেমি-র জেরে সাডেন কার্ডিয়াক ডেথ বেড়ে গিয়েছে। সঙ্গে দোসর করোনার প্রভাব। তাই তাঁরও পরামর্শ, সুস্থ থাকলেও বছরে একবার কার্ডিও চেক-আপ এখন প্রত্যেকের করানো জরুরি।