অরুণাভ রাহারায়
কুহু মুখোপাধ্যায় লেখক হিসেবে বেশ নাম করেছেন। বিখ্যাত ‘স্বর্গ’ পত্রিকায় দু’বার ধারাবাহিক উপন্যাস লিখে তিনি এখন সাহিত্য মহলে সুপরিচিত। তার লেখা নিয়ে ছবিও হয়েছে। তাতে অভিনয় করেছেন অভিনেতা বিকাশ চট্টোপাধ্যায়। তার জার্নি রূপকথাকেও হার মানায়। দারুচিনি চা-বাগানের মেয়ে ছিল। মা বাবা আর দুই বোনের ছোট্ট সংসার। বাগানের স্কুলেই পড়াশোনা। বাড়ির বারান্দা থেকে দেখা যেত ভুটান পাহাড়। লেখাপড়া, নাটক করা আর চা-বাগানের রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়েই ছোটবেলা কেটে গিয়েছে। এখন অবশ্য কলকাতাবাসী। এ অঞ্চল থেকে লেখালিখি করে কুহুর মতো জনপ্রিয় আর কেউ হতে পারেনি। ১৬ বছরের সুস্নাত এসব ভাবে। ওর ভেতরেও লেখক হওয়ার অদম্য ইচ্ছে!
পারিবার সূত্রেই সাহিত্যকে পেয়েছিল কুহু। কাকু প্রবীর ভৌমিক ছিলেন সাহিত্যে নিবেদিত প্রাণ। একাধিক কবিতার বইয়ের রচয়িতা তিনি। শোনা যায় তাঁর বাড়িতে কলকাতা থেকে কবি-লেখকরা মাঝে মধ্যেই আসতেন। আটষট্টি বছর বয়সে ক্যানসার কেড়ে নেয় প্রবীর বাবুর জীবনটা। তাঁর শ্রাদ্ধানুষ্ঠানেই প্রথম কুহুকে দেখছিল সুস্নাত। একটা ভায়োলেট রঙের শাড়িতে। ডান হাতে দামি ঘড়ি। এ অঞ্চলের লেখালিখি করা অনেক মানুষ সেই অনুষ্ঠান বাড়িতে গিয়েছে। সবাই কুহুর সঙ্গে একটু কথা বলার চেষ্টা করছে। সুস্নাতর বাবার বন্ধু ছিলেন প্রবীর বাবু। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। শহরবাসী সমীহ করতেন তাঁকে। শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে সবাই তাঁর সুযোগ্য ভাইঝি তথা বিশিষ্ট লেখিকা কুহু মুখোপাধ্যায়কে সমীহ করছে।
আরও পড়ুন, Durga Puja 2023: লস অ্যাঞ্জেলস যেন লেকটাউন, পুজোয় সরগরম মার্কিন মুলুক
কিছুদিন আগে একটি চ্যানেলে প্যানেল ডিসকাশনে কুহুকে প্রথম টিভির পর্দায় দেখেছিল সুস্নাত। যদিও লেখার সঙ্গে আগেই পরিচয়। ভারি মিষ্টি চেহারা। বয়স চল্লিশের বেশি হবে না। টিভির পর্দায় দেখা সেই লেখিকাকে আজ দেখা যাচ্ছে চোখের সামনেই। সবার খাবারের টেবিলের সামনে গিয়ে তিনি অতিথিদের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করছেন। বাবার পাশে বসে ডাল বেগুনি দিয়ে ভাত খাচ্ছে সুস্নাত। ‘দুয়ারপত্র’ পত্রিকার সম্পাদক প্রিয় লেখিকা কুহুকে কাছে পেয়ে চেয়ে বসলেন নতুন লেখা! কুহু জানালেন, “দু’বছর বাদে আলিপুরদুরারে এলাম। আজ শোকের মাঝে এসব কথা থাক। তাছাড়া আমি আগামী কালই চলে যাচ্ছি জয়ন্তী। সেখানে দু’দিন থেকে ফিরব কলকাতায়। লেখা দেব পরে কখনও।”
কুহু মুখোপাধ্যায়ের কত লেখাই না পড়েছে সুস্নাত। তাঁর লেখার সঙ্গে কত কত দুপুর সন্ধে এমন কি রাত্রিও কাটিয়েছে। তিন ঘণ্টা ট্রেন জার্নি করে শিলিগুড়িতে গিয়ে বিখ্যাত প্রকাশনার আউটলেট থেকে কিনে এনেছে গল্পের বই! নিজের সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিনে পুনর্মুদ্রণ করেছে তাঁর কবিতাও। আগে কবিতা লিখতেন কুহু। এখন কেবল বড় বড় উপন্যাস আর গল্প লেখেন। নভেম্বর মাসে ‘বিতান’ পত্রিকার গল্প সংখ্যায় দিকপাল সাহিত্যিকদের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছিল কুহুর একটি গল্প। ডুয়ার্সে শীতের রাতে লেপের নীচে শুয়ে সুস্নাত সেই গল্প পড়ত আর নিজেও কুহুর মতো লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখত। হায়ার সেকেন্ডারির পর কলকাতায় লেখাপড়া জন্য চলে এল সুস্নাত। কলেজ স্ট্রিটের মেসবাড়িতে বসবাস। এক মফস্বলির চোখ দিয়ে নতুন করে শহরকে দেখা। সুস্নাতর চরিত্রে সারল্য আছে। আর এই কারণেই অনেকে কাছে টেনে নেয় ওকে। কলেজ স্ট্রিটেই কুহু মুখোপাধ্যায়ের অফিস। একদিন প্রিয় লেখিকার সঙ্গে দেখা করতে গেলে কেমন হয়? ভাবে সুস্নাত। কিন্তু কুহুর ফোন নম্বরই তো ওর কাছে নেই! অনেক ভেবে চিন্তে প্রবীর বাবুর ছেলের কাছ থেকে কুহুর নম্বর জোগাড় করে তাঁকে ফোন করে সুস্নাত। ভাগ্য ভাল যে, কুহু অ্যাপোয়েনমেন্ট দেয়। একদিন প্রিয় লেখিকার মুখোমুখি হতে পারে সে। মাত্র ১০ মিনিট থেকে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে ফিরে আসে মেসবাড়িতে।
দেখতে দেখতে নদীর জল গড়িয়ে যায় দূরে। কলকাতায় আসার পাঁচ বছর পর লেখাপড়ার পর্ব চুকিয়ে একটি ডিজিটাল সংবাদ মাধ্যমে রবিবারের সাহিত্যের পৃষ্ঠা সম্পাদনা করার চাকরি পায় সুস্নাত। এমন সময় টাটা লিটারারি অ্যাওয়ার্ড পান কুহু মুখোপাধ্যায়। খবরটি ফেসবুকে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। তখন অফিসের অ্যাসাইনমেন্টে একদিন ইন্টারভিউ নিতে সুস্নাতকে যেতে হয় কুহুর বাড়িতে। গড়িয়া বাস স্ট্যান্ড থেকে অল্প দূরেই কুহুর অ্যাপাটমেন্ট। একটা রিক্সোয় করে যেতে হয়। ছোট্ট ছিমছাম ফ্ল্যাট। দেয়াল জুড়ে বুক সেলফ। পুবের জানলা দিয়ে রোদ আসছে। সুস্নাতর ভেতরটা আনন্দে ভরে যাচ্ছে। প্রবীর বাবুর শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে একদিন যার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েও বলতে পারেনি সে, এখন তারই বাড়িতে এসেছে ইন্টারভিউ নিতে। আনন্দ তো হবেই। গত কয়েক বছর কলকাতা বইমেলায় দেখা হয়েছে ঠিকই, তবে কথা হয়নি একেবারেই। তাছাড়া বইমেলায় তিনি পাঠকদের অটোগ্রাফ দিতে ব্যস্ত থাকেন। আজ পাওয়া গিয়েছে একেবারে একান্তে। সুস্নাত বুম হাতে তাঁকে প্রশ্ন করছে আর অন্য হাতে মোবাইল দিয়ে ভিডিয়ো করে নিচ্ছে একাই। ডিজিটাল সংবাদ মাধ্যমে এখন একা হাতেই এসব সামলাতে হয়। দিনটা সারা জীবনের জন্য সুস্নাতর মনে গেঁথে গেল।
সুস্নাত নিজেও কবিতা লিখে অল্প অল্প নাম করেছে এখন। লেখালিখির সূত্রেই বেশ কয়েক জন নাম করা সাহিত্যিকের সঙ্গে সখ্য। ‘স্বর্গ’ পত্রিকায় পুজো সংখ্যায় ওর কবিতা প্রকাশ পেয়েছে। আর এতেই খুশি হয়ে ওর বাবার এক পুরোনো বন্ধু ফোন করে বাড়িতে নেমন্তন্ন করেছে। আগে আলিপুরদুয়ারে থাকতেন আদিত্য শর্মা। এখন চাকরি সূত্রে কলকাতায়। টালিগঞ্জের করুণাময়ীতে ফ্ল্যাট কিনেছেন। এক রবিবারের দুপুরে আদিত্য কাকুর বাড়িতে খেতে যায় সুস্নাত। তার বউ মালা কাকিমণি বিয়ের আগে দারুচিনি চা বাগানে থাকতেন। সুস্নাত পেশা হিসেবে সাহিত্যকে বেঁছে নিয়েছে জেনে তিনি অভিনন্দিত করেন। বহু পদ দিয়ে খাওয়াদাওয়ার পর গল্প করতে বসে কথায় কথায় উঠে তাদের বাগানের মেয়ে কুহুর প্রসঙ্গ: “আমার খুব গর্ব হয় কুহুদির জন্য। কত কষ্ট করেছে এক সময়। আজ ঠিক সাফল্য এসেছে। ছোটবেলেয় কাছ থেকে দেখেছি, একসঙ্গে অনেকে মিলে দাড়িয়াবান্ধা খেলেছি। একটু বড় হতেই বিপথে চলে যাচ্ছিল। একবার তো কাউকে কিছু না জানিয়ে বিয়ে করে বসল! চুলের আড়ালে সিঁদুর লুকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু নিচু হয়ে ঘর ঝাট দেওয়ার সময় দিদির কাছে ধরা পড়ে যায়। ভাবো তো কি জীবন ছিল। আর এখন রোজই টিভিতে দেখি! দেখে ভালও লাগে। এখনকার বর তো শুনেছি ইঞ্জিনিয়ার, টিসিএসে চাকরি করেন। এখন পোস্টিং টরোন্টোয়।”
ইতিমধ্যে কয়েকটা কবিতার বই প্রকাশ পেয়েছে সুস্নাতর। শেষ বইটা প্রেমের কবিতার সংকলন। অফিসে একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছিল। মেয়েটি ভাল গান গয়। ইউটিউবে গান শুনে প্রায় ষাটখানা কবিতা লিখেছিল দু’মাসে। ওই কবিতাগুলোই সুস্নাতর জীবনে সুসময় বয়ে এনেছে। বইমেলায় বইটি প্রকাশ পাওয়ার পর একটা অনুষ্ঠানে ‘স্বর্গ’ পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে দেখা। স্বাভাবিক ভবেই তাঁকে সদ্য প্রকাশ পাওয়া বইটি দেয় সুস্নাত। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী শিরীণ মিত্র। রেখার কারুকাজে ভারি চমৎকার প্রচ্ছদ। প্রডাকশনও বেশ উন্নত মানের। বইপাড়ায় থাকার সময় দপ্তুরিদের দোকানের সমানে দিয়ে দিনের পর দিন ঘুরে বেড়াত সুস্নাত। ওরা কীরকম খালি গায়ে বসে ছন্দের তালে দুলে দুলে বড় বড় ছাপা কাগজকে ভাজ ক’রে ছোট বইয়ের আকার দেয়! এখন আর সেসব দেখার সময় কই? কিছুদিন হল কলেজ স্ট্রিটের মেসবাড়িটা ছেড়ে যাদবপুরে ফ্ল্যাটে ভাড়া নিয়েছে। ওর ছোট্ট ঘরটাও যেন হয়ে উঠছে কুহু মুখোপাধ্যায়েরের সেই এক টুকরো ঘরের মতো বইপত্রে ঠাঁসা!
একদিন বুক সেলফের পাশের টেবিলে লিখছে সকাল বেলায়, হঠাৎ ‘স্বর্গ’ পত্রিকার সম্পাদক সৌজন্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফোন।
-‘তোমার নতুন বইটা পড়লাম। খুব ভাল লিখেছো কবিতাগুলো। ছোট ছোট লেখা, কিন্তু বেশ গভীর। চালিয়ে যাও ভাই।’
-‘ও আপনার ভাল লেগেছে জেনে খুব আনন্দ হচ্ছে দাদা।’
আরও পড়ুন, Durga Puja 2023: সমাজ, আমরা ও মহীনের সাত তলা বাড়ি
ফোন রেখে বিস্ময় হল সুস্নাতর। এই বিস্ময়গুলো আছে বলেই না বাড়ি ছেড়ে এত দূরে এসে বেঁচে থাকা! এর দু’দিন বাদেই নিউটাউন বইমেলায় কবিতাপাঠ করতে যায় সুস্নাত। গিয়ে দেখে অনুষ্ঠানে এসেছেন সৌজন্য বন্দ্যোপাধ্যায়। মেলার মাঠে দাঁড়িয়ে পিঠে খাচ্ছিল, হঠাৎ পেছন থেকে মহামান্য সম্পাদকের ডাক! সেদিন অনুষ্ঠান শেষ সুস্নাতকে গাড়িতে যাদবপুর পৌঁছে দিয়েছিলেন সৌজন্য বাবু। তিনি সাউথসিটিতে থাকেন। দু’জনের সম্পর্ক বেশ মসৃণ হয়ে উঠেছে।
এর কিছুদিন পর ‘স্বর্গ’ পত্রিকারই এক বিতর্ক সভায় শ্রোতা হিসেবে আমন্ত্রণ পায় সুস্নাত। জাঁকজমকপূর্ণ বিড়লা সভাঘরে অনুষ্ঠান। বহু বিখ্যাত সাহিত্যিক এসেছেন। বক্তারাও সবাই বিশিষ্ট। আগেও নানা অনুষ্ঠানে এমন চাঁদের হাট দেখলেও এখানে এসে সুস্নাতর গর্ব হচ্ছে বেশ। সে ভাবছে, যাদের এত নামডাক তাঁরাও কেমন সুস্নাতর মতোই লাইন দিয়ে একে একে অডিটোরিয়ামে ঢুকলেন। কফি খাওয়ার ফাঁকে সুস্নাত হঠাৎ এক ঝলক দেখতে পেল কুহু মুখোপাধ্যায়কে। তখন সভাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে সবার সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করছেন পত্রিকার সম্পাদক সৌজন্য বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে ঘিরে লেখাকদের ভিড়। সবাই কথা বলার চেষ্টা করছে। ঠিক একদিন যেভাবে প্রবীর বাবুর শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে কুহুর সঙ্গে সবাই কথা বলার চেষ্টা করছিল, তেমনই। সুস্নাত দেখতে পেল, আর পাঁচ জনের মতোই বিশিষ্ট লেখিকা কুহু মুখোপাধ্যায়ও ভিড় ঠেলে সৌজন্য বাবুর কাছে যেতে চাইছে, তাঁর সঙ্গে একটুখানি কথা বলার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে!
(দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির টাটকা খবর, আপডেট এবং ভিডিয়ো পেতে ডাউনলোড-লাইক-ফলো-সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের App, Facebook, Whatsapp Channel, X (Twitter), Youtube, Instagram পেজ-চ্যানেল)