সন্দেশখালিতে শাহজাহানের বাড়িতে তল্লাশি অভিযানে গিয়ে ইডি অফিসাররা নিগৃহীত হওয়ার ৪৮ ঘণ্টা বাদে রবিবার মুখ খুললেন তাঁর ভাই আলমগীর শেখ। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বললেন, ‘দাদা আত্মগোপন করে আছে। যদি জনরোষ তৈরি হয়, সেই আশঙ্কাতেই দাদা বাড়ি ফিরছে না। দাদা আইনি পরামর্শও নিচ্ছে।’ যদিও শাহজাহান কোথায় আত্মগোপন করে রয়েছেন-সে প্রশ্নের উত্তর দেননি আলমগীর।
শনিবার বেশি রাতে সন্দেশখালির সরবেড়িয়ার বাড়িতে ফেরেন শাহজাহানের ভাই। ইডির দাবি, শুক্রবার তল্লাশিতে গিয়ে তদন্তকারীরা দেখেন, শাহজাহানের মোবাইলের টাওয়ার লোকেশন ছিল নিজের বাড়িতেই। অথচ বারবার তাঁর বাড়ির দরজায় ধাক্কা দিলেও কেউ দরজা খোলেননি। যদিও আলমগীরের দাবি, দাদা সে দিন মোবাইল বাড়িতে রেখেই বাইরে বেরিয়েছিলেন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আলমগীর এদিন বলেন, ‘শুক্রবারের ঘটনার সময়ে মোবাইল ফোন বাড়িতে রেখে মর্নিং ওয়াকে গিয়েছিলেন দাদা৷ ইডি বাড়িতে হানা দিতেই তাঁর কাছে গন্ডগোলের খবর পৌঁছয়৷’ আলমগীরের দাবি, ‘কোনও শুভাকাঙ্খীরাই দাদাকে ফোন করে ওই সময়ে বাড়িতে ফিরতে নিষেধ করেন৷’ ইডির অবশ্য সন্দেহ, সে দিনের গোলমালের নেপথ্যে আড়ালে থেকে কলকাঠি নেড়েছেন শাহজাহানই। এবং তারপর থেকে তিনি গা-ঢাকা দিয়ে রয়েছেন। এমনকী সীমান্ত পার করে তিনি বাংলাদেশেও গা-ঢাকা দিতে পারেন, এই সন্দেহে বিএসএফকেও সতর্ক করা হয়েছে।
শুক্রবারের ঘটনা নিয়ে স্থানীয় ন্যাজ়াট থানায় ইডি অভিযোগ করেছে। পাশাপাশি রাজ্য পুলিশের ডিজিপি ও জেলার এসপিকেও গোটা ঘটনাটি আলাদা করে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় এজেন্সি। ইতিমধ্যে রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস এই ঘটনা নিয়ে রাজ্য প্রশাসনের রিপোর্ট চেয়েছেন। তিনি এ-ও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, শাহজাহানের পিছনে কিছু রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশ আধিকারিকের একাংশের মদত রয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, শাহজাহান বাংলাদেশ সীমান্ত পার করেছেন বলে রাজভবনের পিস-রুমে অভিযোগও এসেছে। দ্রুত তাঁকে গ্রেপ্তার করে কমপ্লায়েন্স রিপোর্ট দেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন বোস।
ইডির অভিযোগের ভিত্তিতে খুনের চেষ্টা, মারধর, লুটপাটের মতো জামিনঅযোগ্য ধারায় মামলা রুজু হলেও এখনও পর্যন্ত শাহজাহানের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে কি না অথবা সে দিনের ঘটনায় কতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে-তা নিয়ে রবিবার পর্যন্ত মুখ খোলেনি পুলিশ। এরমধ্যে শাহজাহান আত্মগোপন করে আইনি পরামর্শ নিচ্ছেন বলে তাঁর ভাই দাবি করায় নতুন করে জল্পনা শুরু হয়েছে-তাহলে কি আড়ালে থেকেই আগাম জামিনের আবেদন করবেন শাহজাহান? আলমগীর অবশ্য এরও কোনও জবাব দেননি। শনিবার শাহজাহানের নাম করে যে রেকর্ডেড অডিয়ো মেসেজ প্রকাশ্যে এসেছে, তার উৎস খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
এদিন আলমগীর বলেছেন, ‘আগামী দিনে ইডি সিবিআই বাড়িতে আসলে আমরা অবশ্যই সমস্ত রকম ভাবে সহযোগিতা করব৷ দল আমাদের পাশে আছে, আমরাও দল বিরোধী কোনও কাজ করব না৷ তবে যে ঘটনা ঘটেছে সেটা না ঘটলেই ভাল হতো৷’ তাঁর দাবি, ‘শুক্রবার আমাদের বাড়ির সামনে ইডি বা সংবাদমাধ্যমের কাউকে মারধর বা ভাঙচুর করা হয়নি৷ যে ঘটনা ঘটেছে তা সরবেড়িয়া এলাকার বাইরে৷ গ্রামবাসীরা যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোন ঘটনা ঘটিয়ে থাকেন, তাহলে তাঁরা সরল মনে সেই কাজ করেছেন। তাঁরা বুঝতে পারেননি এই ঘটনার এত বড় প্রভাব পড়তে পারে৷ আমি ব্যক্তিগতভাবে এই ঘটনাকে সমর্থন করি না।’
যদিও গোটা ঘটনার জন্য বিরোধীদের উস্কানিকেই দায়ী করেছেন শাহজাহানের ভাই। তাঁর অভিযোগ, ‘ইডি তল্লাশির দু’দিন আগেই শুভেন্দু অধিকারী বসিরহাটের সভা থেকে যে প্ররোচনা দিয়েছেন, তার জন্যই এরকম একটা ঘটনা ঘটল৷’ বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী অবশ্য শাহজাহানের বিরুদ্ধে দেশবিরোধী কাজে যুক্ত থাকার অভিযোগ তুলেছেন। রবিবার নন্দীগ্রামের শহিদ দিবস অনুষ্ঠানে এসে শুভেন্দুর বক্তব্য, ‘আমি রাজ্যপালকে বলব, রাজ্যের ৩০ থেকে ৪০টি থানাকে চিহ্নিত করে ৩৫৫ ধারা প্রয়োগ করেন। তাহলেই সব টাইট হয়ে যাবে।’
তাঁর সংযোজন, ‘শেখ শাহজাহান দেশবিরোধী কাজ করছেন, তাঁকে ধরা হোক বলে রাজ্যপাল যে স্টেটমেন্ট দিয়েছেন, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ আলমগীর অবশ্য তাঁর দাদা ও পরিবারের বিরুদ্ধে ওঠা যাবতীয় অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর দাবি, ‘আমাদের সম্পত্তি বৃদ্ধি নিয়ে রাজনৈতিক হিংসা থেকে এসব অভিযোগ করা হচ্ছে৷ প্রত্যেকে পরিশ্রম করে, ব্যবসা করে আমরা এই জায়গায় উঠে এসেছি৷ আমরা আদিবাসী সহ সমস্ত মানুষের পাশে থাকি৷ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া নিয়েও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন অভিযোগ তোলা হচ্ছে৷’
রাজ্য পুলিশের বিরুদ্ধে শুভেন্দুর অভিযোগ, ‘পুলিশ দলদাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে। সাধারণ মানুষের অর্থ তছরুপে জড়িত শাহজাহানের মতো অপরাধীদের ধরতে ইডি অভিযান চালালে পুলিশের দেখা মেলে না।’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর তোপ, ‘পশ্চিমবঙ্গে লুক আফটার সরকার আছে। তৃণমূলের এই সমস্ত বিপজ্জনক লোকেদের নামে লুক আউট নোটিস দিয়ে কী করবে ইডি?’
তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষের পাল্টা বক্তব্য, ‘সন্দেশখালিতে ইডিই সাধারণ মানুষকে প্রভোক করেছিল। কাউকে না জানিয়ে সাত সকালে এলাকার একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির বাড়িতে রীতিমতো হামলা চালিয়েছিল। সাধারণ মানুষকে ক্ষিপ্ত করতেই কাউকে না জানিয়ে এভাবে হামলা চালানোর মতো পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল।’