তাও উড়ে যায় বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া চোপরো নদী পার করে। আর ওই টিনের খোঁজ মেলেনি। দুই ছেলে-মেয়ের বই খাতা এখনও চপচপে হয়ে ভিজে আছে। পূর্বপাড়ায় যত দূর চোখ যায়, ছয়দিন পরেও নজরে আসে শুধুই ধংসের ছবি। কোনও বাড়ির টিন আস্ত নেই। কাগজের মতো ছিঁড়ে কুটিপাটি হয়ে গিয়েছে।
ববিতা ফের বলে ওঠেন ‘পড়শিদের কাছ থেকে খবর পেয়ে স্বামী ছুটে এসেছেন কেরালা থেকে। সঙ্গে এনেছেন সামান্য টাকা। তাই দিয়ে কোনও রকমে কয়েকটি টিন কিনে নিজেরাই ছাপড়া তুলেছি। স্টিলের খাট ভেঙে চুরমার। তাই মাটিতেই মাথা রাখি চার জনে। ওই খাটের নীচে আশ্রয় নিয়েই আমার ছেলে-মেয়ে দুটো বেঁচে যায়। সম্বল বলতে এখন হাতে আছে জেলা প্রশাসনের দেওয়া এক বস্তা চাল। তাই দিয়েই খিদে মেটাতে হচ্ছে। রেশন কার্ড হারিয়েছি। তাই রেশনও অমিল। ভোটের কথা মাথাতেই নেই। এখন সময় নতুন করে সংসার গড়ার।’
শুধু ববিতাই নন। গোটা গ্রামটাই এখন অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে নেমেছে। আকাশ সামান্য মুখভার করলেই শিউড়ে উঠছেন তাঁরা। গোবিন্দ দাস বলেন, ‘কেরালায় শাটারিংয়ের কাজ করি। কিছু টাকা নিয়ে ফিরেছিলাম। তার বেশির ভাগ উড়ে গিয়েছে ঝড়ে। স্ত্রী আহত। কোলের বাচ্চাটাও কেমন যেন ভয়ে সিঁটিয়ে আছে। ঘর তো নেই দেখতেই পাচ্ছেন। ভোট মাথায় নেই। এখন আমার সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, স্ত্রী-সন্তানকে কোথায়, কার ভরসায় রেখে যাব? এখানে তো কাজ নেই। আমি কেরালায় না ফিরলে ওদের উপোস করে থাকতে হবে।’
একটা আস্ত মহল্লা ওলট-পালট হয়ে যাওয়ায় ঝোপ বুঝে কোপ মারতে আসরে হাজির সুদের কারবারিরা। উৎপল দাস বলেন, ‘বউটাকে কোথায় রেখে যাব? ঘর উড়ে গিয়েছে। টিনের খোঁজ নেই। অগত্যা চড়া সুদে আট হাজার টাকা ধার করে একটা চালা তৈরি করছি। সুদ ছাড়া টাকা কে দেবে?’
গত রবিবার ঝড়ের তাণ্ডবের পরে সবে এই শনিবার গ্রামে বিদ্যুৎ ফিরে এসেছে। যোগেন্দ্র দাস বলেন, ‘বিদ্যুৎ ফিরেছে। তবে আলো জ্বলবে কোথায়? ঘরই তো নেই। প্রশাসন যদি দয়া করে পথবাতির ব্যবস্থা করে দেয়, তবুও অন্ধকার কিছুটা কাটে। ভোট-ভোটের নিয়ম তো থাকবেই। তাই বলে আমরা এতটুকু পেতে পারি না? নিয়মটাই বড়? মানুষের দাম নেই?’
দক্ষিণ কামসিং গ্রামের পূর্বপাড়া যেন সত্যিই এক নেই রাজ্যের দেশ। তাঁদের সাক্ষী হিসেবে এখন ওই মহল্লার উত্তর ও দক্ষিণ দিক দিয়ে নীরবে বয়ে চলেছে চোপরো আর কুরমাই নদী।