গোটা ঘটনার ভরকেন্দ্র রায়গঞ্জ থানার বিন্দোল গ্রাম পঞ্চায়েতের জালিপাড়া। মাইজলি বর্মনের অভিযোগ, মাস কয়েক আগে বিন্দোলের জালিপাড়ার বাসিন্দা রবি তাঁকে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানেই ২০ লক্ষ টাকার চুক্তিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁর একটি কিডনি কেটে নেয়।কিন্তু তিনি কিডনি বিক্রি করতে গেলেন কেন? পরিযায়ী শ্রমিক কার্তিক বর্মনের স্ত্রী মাইজলি বলেন, ‘মেয়ের বিয়ে দেওয়ার পরে মহাজনের কাছে প্রচুর টাকা ঋণ হয়ে গিয়েছিল। শোধ করতে পারছিলাম না। সেই কথা কোনওভাবে জেনে জালিপাড়ার রবি জালি আমার কাছে প্রস্তাব দেয়, আমার একটি কিডনি বিক্রি করে দিলে নগদ ১৫ লক্ষ টাকা হাতে পাব। তাই ভেবেছিলাম, ওই টাকা দিয়ে মহাজনের ঋণ শোধ করেও যা বাঁচবে, তা দিয়ে আমার সংসার ভালোভাবে চলবে।’
মাইজলির দাবি, চুক্তিমতো ২০ লক্ষ টাকার মধ্যে দালালি বাবদ ৫ লক্ষ টাকা নেওয়ার কথা ছিল রবির। বাকি ১৫ লক্ষ টাকা দেওয়ার কথা ছিল তাঁর হাতে। কিন্তু মাত্র ৫ লক্ষ দিয়ে বাকি টাকা আর দিচ্ছেন না রবি। সম্প্রতি বকেয়া চাইতে গেলে মাইজলিকে মারধর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ।
অভিযুক্ত রবি জালি এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে তাঁর ভাই ছবি জালি বলেন, ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ। ১০-১২ বছর আগে এই গ্রামে কিডনি পাচার চক্র ছিল। কিন্তু এখন সব বন্ধ। আমার স্ত্রী পঞ্চায়েত সদস্য। দাদা গাড়ি চালায়। ওই মহিলার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছিলেন। সেটাকে কেন্দ্র করেই চক্রান্ত করে আমার দাদাকে ফাঁসানোর চেষ্টা হচ্ছে।’
বিন্দোল গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান জিন্নাতুন খাতুন বলেন, ‘শুনেই অবাক হয়ে যাচ্ছি। এরকম ঘটনা অনেক আগে শুনতাম। তবে ওই মহিলা যখন অভিযোগ করছেন, আমরা নিশ্চয় পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেব।’
প্রতারিত মাইজলি বর্মন সংবাদ মাধ্যমের কাছে মৌখিক ভাবে দালালের খপ্পরে পড়ে কিডনি বিক্রির অভিযোগ করলেও গত ৪ জুন রায়গঞ্জ থানায় দায়ের করা লিখিত অভিযোগে তিনি কিডনি সংক্রান্ত কোনও কথা উল্লেখ করেননি। রবি তাঁর কাছ থেকে নেওয়া ধারের টাকা শোধ করছেন না বলেই তিনি অভিযোগ পত্রে উল্লেখ করেছেন।
রায়গঞ্জের মহকুমা শাসক কিংশুক মাইতি বলেন, ‘বিষয়টি সংবাদমাধ্যমের কাছেই জানতে পারলাম। আমি ওই ভদ্রমহিলাকে পরামর্শ দেবো, এভাবে শুধু সংবাদমাধ্যমের কাছে মৌখিক অভিযোগ না করে তিনি যেন থানায় বা জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের কাছে যথাযথ লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। তাহলেই সঠিক তদন্ত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
নব্বইয়ের দশকে প্রথম কিডনি পাচার কাণ্ডে উঠে আসে রায়গঞ্জ ব্লকের বিন্দোল গ্রাম পঞ্চায়েতের জালিপাড়ার নাম। বিন্দোলেরই বাসিন্দা মহম্মদ রেজ্জাক নামে এক ব্যক্তি প্রথম এই কারবার শুরু করে বলে অভিযোগ। পরে শেখ কুদ্দুস নামে আরও এক ব্যক্তি এই চক্রের মাথা হয়ে ওঠে। এই দুই কিংপিনের গড়ে তোলা চক্র গ্রামবাসীদের কাজের প্রলোভন দেখিয়ে বাইরে নিয়ে গিয়ে কিডনি কেটে নিত বলে অভিযোগ।
অভাবের তাড়নায় বিন্দোলের জালিপাড়ার বহু মানুষ এই চক্রের খপ্পরে পড়ে কিডনি খুইয়েছেন। পরে পুলিশ-প্রশাসন ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সক্রিয়তায় বন্ধ হয়ে যায় এই কালো কারবার। নতুন কোনও কিংপিনের হাত ধরে ফের কি সক্রিয় হয়ে উঠছে কিডনি পাচার চক্র? ঘুরপাক খাচ্ছে সেই প্রশ্নই।