এই সময়: গত বছর ডিসেম্বরের ঘটনা। গুজরাটের রাজকোটে এক মহল্লায় চার বছরের একটি মেয়ে খেলতে বেরিয়েছিল। তখনই হঠাৎ মেয়েটির উপর হামলা চালায় ৮-১০টি কুকুরের দল। রক্তাক্ত অবস্থায় মেয়েটিকে উদ্ধার করা হলেও শেষরক্ষা হয়নি। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার।চলতি বছরের মে মাসের ঘটনার কথাও ধরা যেতে পারে। তেলঙ্গানার ভিকারাবাদ জেলায় পাঁচ মাসের ঘুমন্ত শিশুর উপর আক্রমণ করে একটি পথকুকুর। শিশুটি নিজের বিছানায় ঘুমোচ্ছিল, ঘরে তখন কেউ ছিল না। অভিযোগ, পথকুকুরটি তখনই ঘরে ঢোকে এবং এমন ভাবেই শিশুটিকে আক্রমণ করে যে, তারও ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়। পরে ওই কুকুরটিকে পিটিয়ে মারেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

দিল্লি, গুজরাট বা পশ্চিমবঙ্গ- দেশের নানা প্রান্ত থেকেই ইদানিং পাওয়া যাচ্ছে এমন খবর, যেখানে কুকুর-মানুষে দ্বন্দ্ব রক্তক্ষয়ী এবং প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে। কুকুরদের ওপর মানুষের অত্যাচারের খবরও কম আসছে এমন নয়। উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়া এই ‘কনফ্লিক্ট’ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন বিজ্ঞানী ও সমাজকর্মীরা। তাঁরা এই দ্বন্দ্ব-হিংসার বেশ কিছু কারণও চিহ্নিত করেছেন।

বুধবার কলকাতা প্রেস ক্লাবে একটি সাংবাদিক বৈঠকে এই উদ্বেগ ও কারণ নিয়েই বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরা মুখোমুখি হয়েছিলেন। তাঁদের মতে, এই দ্বন্দ্বের কারণগুলিতে মানুষের দায়ই সবচেয়ে বেশি! আইসার কলকাতার ডগ ল্যাবের প্রধান বিজ্ঞানী অনিন্দিতা ভদ্রের মতে, এই পারস্পরিক হিংসা ও দ্বন্দ্বের মূল কারণ চারটি। তার অন্যতম, অপরিকল্পিত ভাবে কুকুরদের খাবার দেওয়া।

অনিন্দিতার কথায়, ‘দেখবেন, কোনও কোনও পাড়ায় কুকুরের সংখ্যা অত্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে। দেখা যাবে সেখানে এক বা একাধিক ব্যক্তি কুকুরদের নিয়মিত খাবার দিচ্ছেন। অন্য জায়গায় সেই অনুপাতে খাবার দেওয়া হচ্ছে না বা একেবারেই খাবার দেওয়া হচ্ছে না।’ এই অপরিকল্পিত ফিডিংয়ের জন্য একটা এলাকায় খাবার না পেয়ে কুকুর কমছে, অন্য এলাকায় খাবার পেয়ে কুকুর বাড়ছে। এতে এলাকা এবং খাবারের দখল নিয়ে কুকুরদের মধ্যে যেমন প্রতিযোগিতা, মারামারি বাড়ছে, তেমনই সেই গোলমালের মধ্যে মানুষ পড়ে গেলে তার উপরেও হামলা করছে সারমেয়রা।

অনিন্দিতাদের মতে, পরিকল্পনা করে খাবার না-দিলে এই দ্বন্দ্ব বাড়বেই। দ্বন্দ্বের আরও একটি কারণ, সন্তান জন্ম দেওয়ার পর মা কুকুররা ছানাকে নিয়ে অত্যন্ত প্রোটেকটিভ থাকে। তখন অতিরিক্ত আদর থেকে ছানাদের কেউ ভালোবাসতে গেলে বা কেউ আক্রমণ করলে মা কুকুর পাল্টা হামলা করছে। মেটিং সিজ়নে যখন কুকুররা যৌনতায় লিপ্ত, তখন মানুষের অকারণ ভয় দেখানো, ঢিল ছোড়ার ঘটনা থেকেও আক্রমণের সংখ্যা বাড়ছে।

বেঙ্গালুরুর স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মী অংশুমান দশরথী জানাচ্ছেন, ২০২৩ সালে পশ্চিমবঙ্গে কুকুরের কামড়ের ঘটনা ঘটেছে ৪২,৯০৫টি। সারা দেশে ২ কোটি ৭৫ লক্ষেরও বেশি কুকুরের কামড়ের ঘটনা রিপোর্টেড হয়েছে। এই উর্ধ্বমুখী ট্রেন্ডে উদ্বিগ্ন অংশুমান বলছেন, ‘মানুষ বলেই আমরা কুকুরদের জীবন নির্ধারণ করতে পারি না। প্রাকৃতিক নিয়মকে উপেক্ষা করে কুকুরদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় হস্তক্ষেপ না করে বরং বিজ্ঞানসম্মত ভাবে এগোলে এই দ্বন্দ্ব-হিংসা কমতে পারে।’

অনিন্দিতারা জানাচ্ছেন, ৬৩% পথকুকুরের মৃত্যু ঘটে মানুষের কারণে। তা সে গাড়ি চাপা হোক অথবা অতিরিক্ত ভালোবাসায় সদ্য জন্মানো কুকুরছানাকে তুলে আনা। মা ছাড়া যে শাবক ভালো থাকতে পারে না সেটা ডগ লাভারদের বুঝতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

Bird Flu In Humans : মুরগির মাংস-ডিম খাওয়া নিয়ে আতঙ্ক! মানুষের শরীরে কী ভাবে থাবা বার্ড ফ্লুয়ের? ব্যাখ্যা বিশেষজ্ঞদের

এই প্রেক্ষিতে অনেকেরই মনে পড়ে যাচ্ছে, ২০১৫ সালে কেন্দ্রীয় মানবাধিকার সংগঠন সারা দেশে সমীক্ষা করার দাবি তুলেছিল। সমীক্ষায় তারা জানতে চেয়েছিল, মানুষের অধিকার না পশুর অধিকার, কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ? পথকুকুরদের নিয়ে কাজ করেন অভিনেত্রী দেবলীনা দত্ত। তাঁর কথায়, ‘যাঁরা ডগ লাভার, তাঁদেরই ঠিক করতে হবে যে, এই এলাকায় যদি আমি খাবার দিই, তাহলে পাশের এলাকায় অন্য কাউকে যেতে হবে। কুকুরদের উপর মানুষের অকারণ আক্রমণের বিরুদ্ধে মিউমিউ করলেও চলবে না।’

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভিসি তথা সল্টলেকের বাসিন্দা অভিজিৎ চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘খাবার পরিকল্পনা করে দেওয়া, নিয়মিত কুকুরদের নির্বিজকরণ এবং ভ্যাকসিনেশনের দিকে নজর রাখলেই এই সমস্যা বাড়ে না।’ দেবলীনা এবং অভিজিৎ দুজনেই মনে করেন, অকারণ আক্রমণ বন্ধ করলেই এই দ্বন্দ্বের নিরসন হবে।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version