মণিপুষ্পক সেনগুপ্ত
কতটা পথ হাঁটলে তবে পুলিশ রুখে দাঁড়ায়! পথ যে আর ফুরোয় না। পুলিশও কিছু বলে না। এটা নবান্ন অভিযান নাকি লং-মার্চ! আন্দোলনকারীদের কপালে চাওড়া ভাঁজ। র‍্যাফ, ব্যারিকেড, জল কামান, কাঁদানে গ্যাস সব গেল কোথায়? যতদূর চোখ যায়, সে সব কিছুই যে চোখে পড়ে না। ধূ ধূ রাজপথ। মিছিল নবান্নে গিয়েই থামবে নাকি!—‘এই যে স্যার, আপনারা ব্যারিকেডটা কোথায় করেছেন বলুন তো? আর কতটা হাঁটাবেন?’ মিছিল থেকে ছিটকে এল প্রশ্নটা। আর মিছিলের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলা পুলিশ বাহিনী থেকে জবাব ভেসে এল, ‘আপনারা নবান্নে যাবেন তো। চলুন না। সবে তো আকাশবানী পৌঁছোলেন।’

মিছিল যত চলতে থাকে, আন্দোলনকারীদের বিরক্তিও তত বাড়তে থাকে। আরজি করের ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদত্যাগ চাওয়া আন্দোলনকারীরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ঠাওর করার চেষ্টা করেন, পুলিশের ছকটা ঠিক কী। ওরা হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে ক্লান্ত করে দিতে চায় নাকি!

আরজি কর হাসপাতালের তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় উত্তাল বঙ্গ-সমাজ। এই আবহে ক’দিন আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় নবান্ন অভিযানের ডাক দেয় ‘ছাত্র সমাজ’ নামে একটি সংগঠন। এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে এ দিন শহরের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ তৎপরতা ছিল নজিরবিহীন। মঙ্গলবার দুপুর সোওয়া একটা নাগাদ কলেজ স্কোয়ার থেকে ‘ছাত্র-সমাজ’-এর লম্বা মিছিল বার হয়। লক্ষ্য নবান্ন।

কলেজ স্কোয়ার থেকে ওয়েলিংটন হয়ে এসএন ব্যানার্জি রোড ধরে মিছিল এগোতে থাকে ধর্মতলার দিকে। আন্দোলনকারীদের ধারণা ছিল, ধর্মতলা চত্বরেই তাঁদের আটকে দেবে পুলিশ। সেখানেই চলবে জল কামান আর কাঁদানে গ্যাস। কিন্তু এ কী! ধর্মতলা যে ভোঁভা। কিছু পুলিশ শুধু দাঁড়িয়ে আছে নবান্নের পথ দেখানোর জন্য। কলেজ স্কোয়ার থেকে ধর্মতলা তো কম পথ নয়। সুতারং ছোট্ট বিরতি আন্দোলনকারীদের।ভিড় বাড়ছে ধর্মতলায়। মিছিলের লেজ তখনও ওয়েলিংটনে। এগোতে হবে সামনে, যেতে হবে নবান্নে। ‘ছাত্র সমাজ’-এর নেতারা স্লোগান তুললেন, ‘বুকের আগুন নিভতে দেওয়া যাবে না। সব বাধা উপেক্ষা করে এগিয়ে যেতে হবে নবান্নে।’

দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো ধর্মতলা চত্বরে ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা কিছু গার্ড রেল হাতের সামনে পেয়ে প্রবল আক্রোশে তা ভেঙে ফেলেন আন্দোলনকারীরা। ছেড়া হয় তৃণমূলের কিছু ফেস্টুন-প্ল্যাকার্ডও। কিন্তু জল কামান, কাঁদানে গ্যাস, স্টিলের ব্যারিকেডের দেখা যে মেলে না কিছুতেই। রানী রাসমণি অ্যাভিনিউ অতিক্রম করে ময়দানের পাশ দিয়ে মিছিল দুপুর আড়াইটে নাগাদ পৌঁছায় ইডেন উদ্যানের সামনে। সামনে বাবুঘাট।

কিন্তু সেখানেও তো কোনও ব্যারিকেড চোখে পড়ছে না। ব্যারিকেড না থাক, ওই তো গঙ্গা। আর গঙ্গার ওপারেই নবান্ন। সে কথা আন্দোলনকারীদের স্মরণ করিয়ে ‘ছাত্র সমাজ’-এর এক নেতা মাইক ফুঁকে বললেন, ‘আর বেশি দূর নয়। ওই যে নবান্ন দেখা যাচ্ছে। চলুন, এগিয়ে চলুন। গতি বাড়ান।’

নবান্ন অভিযান থেকে গ্রেপ্তার ২২০ জন, আহত ১৫ জন পুলিশ কর্মী

কিন্তু পা যে আর চলে না! তার মধ্যে আবার কালো মেঘ কেটে রোদ চড়তে শুরু করেছে। প্রচণ্ড আদ্রতা। এ বার রাস্তায় বসেই পড়ল ‘ছাত্র সমাজ’—একটু বিশ্রাম। দু’দণ্ড জিরিয়ে না নিলে অগামীর পথ চলা অসম্ভব। চোখেমুখে ঠান্ডা জল ছিটিয়ে এক আন্দোলনকারী বললেন, ‘বুঝলেন দাদা, এটা আসলে পুলিশের খেলা। আমাদের হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত করে দিতে চাইছে। ধর্মতলাতেই তো পুলিশ আমাদের আটকাতে পারত। নবান্নে তো আর ঢুকতে দেবে না। তা হলে বেকার হাঁটাচ্ছে কেন?’

এক মহিলা আন্দোলনকারীর ব্যাখ্যা, ‘এটাই তো পুলিশের ছক। যাতে ক্লান্ত হয়ে আমাদের অনেকে মাঝ রাস্তাতেই যুদ্ধ থেকে ওয়াকওভার দিয়ে দেয়। কিন্তু সেটা আমরা হতে দেবো না। ছ’কিলোমিটার হেঁটে ফেলেছি। প্রয়োজনে আরও ছ’কিলোমিটার হাঁটব। কিন্তু থামব না।’

মিছিল সত্যি-ই থামেনি। বাবুঘাট ছেড়ে প্রিন্সেপ ঘাট টপকে আরও কিছুটা এগোনোর পর হেস্টিংসের কাছে শেষমেষ দেখা মিলল পুলিশি ব্যারিকেডের। ওই তো জল কামান, ওই যে কত পুলিশ। কপালের ঘাম মুছে হাঁফ ছাড়লেন কলেজ স্কোয়ার থেকে হাঁটতে শুরু করা আন্দোলনকারীরা। নবান্ন না মিলুক। সুনসান রাস্তায় পুলিশের ব্যারিকেড তো মিলেছে! জল কামান চলে চলুক, হাঁটতে তো হবে না আর। শান্তি।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version