মণিপুস্পক সেনগুপ্ত
ধর্মতলা চত্বর জুড়ে তখন একটাই আওয়াজ ‘জাস্টিস ফর আরজি কর।’ যার সঙ্গে ‘মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ’ অংশটুকু মাইক ফুঁকেও জুড়তে পাড়লেন না মঞ্চ বেঁধে বসে থাকা বিজেপি নেতারা। রবিবার বিকেলে ধর্মতলায় স্লোগান-যুদ্ধে অন্তত দলীয় রাজনীতিকে গো-হারা হারিয়ে দিল নাগরিক আন্দোলন।আরজি কর হাসপাতালের তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় উত্তাল গোটা রাজ্য। প্রতিদিনই রাজপথে আছড়ে পড়ছে নাগরিক ক্ষোভ। পথে নেমেছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিও। নাগরিক মিছিলের পাশাপাশি রাজনৈতিক মিছিলও চলছে।

বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি প্রত্যাশিত ভাবেই চাইছে, আরজি কর ইস্যুতে সাধারণ মানুষের ক্ষোভকে পুঁজি করে নিজেদের পায়ের তলার মাটি শক্ত করতে। কিন্তু এ দিন এক ভিন্ন ছবি দেখা গেল ধর্মতলায়। দলীয় পতাকাহীন নাগরিক মিছিলকে উৎসাহ দেওয়ার বদলে তাদের সঙ্গে কার্যত পায়ে-পা দিয়ে স্লোগান যুদ্ধে জড়াল বিজেপি!

আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদে রবিবার কলেজ স্কোয়ার থেকে রানী রাসমণি অ্যাভিনিউ পর্যন্ত মহা-মিছিলের ডাক দেয় নাগরিক সমাজ। হাজার হাজার সাধারণ মানুষ ছাড়াও সেই মিছিলে হাঁটেন টলিউডের বহু অভিনেতা-অভিনেত্রী। ছিলেন অপর্ণা সেনও। মিছিল থেকে যেমন ‘জাস্টিস ফর আরজি কর’ স্লোগান ওঠে, তেমনই ‘কন্যা যদি না-ই থাকে, কন্যাশ্রী কাকে দেবে?’-র মতো রাজ্য সরকারকে নিশানা করে স্লোগানও ওঠে।

এমনকী, সিবিআই কেন এতদিনেও দোষীদের ধরতে পারছে না, সেই প্রশ্নও তোলা হয় এই মহা-মিছিল থেকে। মিছিলের শেষ প্রান্ত থেকে একবার মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি উঠলেও তা সঙ্গে সঙ্গে থামিয়ে দেওয়া হয়। অভিনেত্রী চৈতি ঘোষালের কথায়, ‘আমরা এই মিছিলে সবাই সাধারণ মানুষ হিসেবে এসেছি। আমাদের একটাই লক্ষ্য, দ্রুত বিচার চাই। দোষীদের শাস্তি চাই। রাজনীতি করার জন্য এই মিছিল নয়।’

আপাতভাবে নাগরিক সমাজের এই মিছিলের দাবি-দাওয়ার সঙ্গে কোনও বিরোধ নেই রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপির। বিরোধ তবুও বাঁধল। এবং শহরের প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলাতেই বাঁধল।

এ দিন দুপুর তিনটে নাগাদ কলেজ স্কোয়ার থেকে মহা-মিছিল এসএন ব্যানার্জি রোড ধরে এগোতে থাকে ধর্মতলার দিকে। সেখানে, ডোরিনা ক্রসিং-এর মুখে গত চারদিন ধরে মঞ্চ বেঁধে ধর্নায় বসে আছে বিজেপি। তাদের মূল দাবি, আরজি করের ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ চাই। ধর্মতলা চত্বরে মাইক বেঁধে বিজেপি নেতারা সেই দাবি তুলছেন নিয়ম করেই।

ঠিক এর মধ্যেই ধর্মতলায় ডোরিনা ক্রসিং-এর সামনে এসে পৌঁছয় নাগরিক সমাজের মহা-মিছিলের মাথা। লেজ তখনও ওয়েলিংটনে। ধর্নামঞ্চে বসে থাকা বিজেপি নেতারা অবশ্য এই মিছিলকে বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে সভার কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন মাইক ফুঁকেই।

কিছুক্ষণ সেই মাইক বন্ধ রাখতে মহা-মিছিল থেকে বিজেপি নেতৃত্বকে আর্জি জানানো হয়। কারণ, বিজেপি নেতাদের ভাষণে চাপা পড়ে যাচ্ছে নাগরিক সমাজের ‘জাস্টিস ফর আরজি কর’ স্লোগান।

বিজেপির মঞ্চে তখন হাজির ছিলেন দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারও। তবুও নাগরিক সমাজের আর্জিতে সাড়া দেয়নি বিজেপি। মাইক বাজতেই থাকে। শুধু ভাষণের বদলে ‘মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ চাই’ স্লোগান দিতে থাকেন তাঁরা। বিজেপি নেতারা হয়তো ভেবেছিলেন, ‘জাস্টিস ফর আরজি কর’ স্লোগান ছেড়ে তাঁদের স্লোগানেই গলা মেলাবেন জনতা।

তা কিন্তু হলো না। উল্টে জনতা দেখিয়ে দিল খালি গলার জোর। চোঙা থেকে ভেসে আসা বিজেপির ‘দাবি এক, দফা এক, মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ’কে ছাপিয়ে গেল হাজার হাজার মানুষের সমবেত কণ্ঠ ‘জাস্টিস ফর আরজি কর।’ মিছিলের শুরুতে যাঁরা আরজি কর ইস্যুতে মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করে স্লোগান তোলার চেষ্টা করেছিলেন, ধর্মতলায় পৌঁছে তাঁরাও গলা মেলালেন না বিজেপির স্লোগানের সঙ্গে।

তবে বিজেপি একা নয়, সাধারণ মানুষের সঙ্গে ইতিমধ্যে স্লোগান যুদ্ধে জড়িয়েছে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসও। আরজি করের ঘটনার দ্রুত বিচার চেয়ে শনিবার কলেজ স্কোয়ার থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত মিছিল করে শহরের কুড়িটি স্কুলের প্রাক্তনীরা। বিবেকানন্দ রোডের মুখে সেই মিছিলকেও পড়তে হয় তৃণমূলের সভার স্লোগানের মুখে। এ দিনের মতো শনিবারও অবশ্য জনতার স্লোগানের কাছে দাঁড়াতে পারেনি রাজনৈতিক স্লোগান।

​​আজ লালবাজার অভিযানে নামছেন জুনিয়র ডাক্তাররা
তবে এ দিন কিন্তু ধর্নামঞ্চে হাজির থাকা বিজেপির অনেকেই চাননি নাগরিক সমাজের মিছিলের সঙ্গে সংঘাতে জড়াতে। এক পদ্ম নেতার কথায়, ‘আমরা অনেকেই বলেছিলাম, নাগরিক সমাজের মিছিল চলাকালীন মাইক বন্ধ রাখতে। স্লোগান দিতে হলে শুধু একটাই স্লোগান দেওয়া উচিত, উই ওয়ান্ট জাস্টিস। তাতে জনতাও গলা মেলাত। আমরা সেই সুযোগ হাতছাড়া করলাম। উল্টে পতাকাহীন মিছিলের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে তৃণমূলের সুবিধা করে দিলাম। পুলিশ আমাদের আর জনতার মাঝখানে পাঁচিল তুলে না দাঁড়ালে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটতে পারত।’

নাগরিক মিছিল ধর্মতলা ছেড়ে রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ের দিকে এগোতে শুরু করার পরে বিজেপির ধর্নামঞ্চ থেকে সুকান্ত মজুমদার বলেন, ‘জাস্টিস তো আমরাও চাই। কিন্তু শুধু জাস্টিস চাইলেও তো হবে না। তৃণমূল সরকারকে উৎখাত করে আসল কাজটাও করতে হবে। না হলে আরজি করের মতো ঘটনা আবার ঘটবে। সেটাও সবার বোঝা উচিত।’

সুকান্ত যখন নাগরিক আন্দোলনকে রাজনীতির ছাতার তলায় আনার বার্তা দিচ্ছেন, নাগরিক মিছিল তখন খালি গলায় অরিজিৎ সিং-এর গান ধরেছে, ‘আর কবে চিত্ত স্বাধীন হবে?’ রানি রাসমণি অ্যাভিনিউ থেকে সারা রাত ভেসে আসে সেই গান।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version