সব্যসাচী বাগচী
খেলার শুরুর দিন থেকেই রুপোর রঞ্জি ট্রফিটা (Ranji Trophy) ইডেন গার্ডেন্সের (Eden Gardens) সৌরাষ্ট্রর (Saurashtra) ড্রেসিংরুমের কিছুটা বাইরে রাখা আছে। যতক্ষণ খেলা চলছে, ততক্ষণ ট্রফিটা রাখার পরিকল্পনা নিয়েছে বিসিসিআই (BCCI)। দু’দিন ধরেই একটা অদ্ভুত ছবি ধরা পড়ল। তিন বছর আগে রঞ্জিজয়ী দলের ক্রিকেটাররা মাঠের দিকে আসা-যাওয়া করার সময় সেই ট্রফিতে হাত বুলিয়ে নিচ্ছেন। অধিনায়ক জয়দেব উনাদকাট (Jaydev Unadkat) থেকে বাকিরাও থেমে নেই। ছবিটা আপাতদৃষ্টিতে প্রতীকী হলেও, বড্ড চোখে লাগে। সবাই কি বল পড়ার আগেই বুঝে গিয়েছিল, সৌরাষ্ট্রের রঞ্জি জয় শুধু সময়ের অপেক্ষা!
এবারও সেই চায়ের কাপ এবং ঠোঁটের তফাৎ সেই থেকেই গেল। সকাল থেকেই কলকাতার আকাশের মুখ ভার। তেমনই মুখ ভার করে থাকলেন মনোজ তিওয়ারিও (Manoj Tiwary)। মন্দ আলোর জন্য খেলা বন্ধ হওয়ার সময় স্কোরবোর্ড বলছে সৌরাষ্ট্র ৩১৭ রানে ৫ উইকেট। লিড ১৪৩ রানের। খাতায়-কলমে ম্যাচ এখনও শেষ হয়নি। তৃতীয় দিনের প্রথম সেশনে বিপক্ষকে অল আউট করে, দ্বিতীয় ইনিংসে বড় রান করলে, বাংলা এই ম্যাচে ফিরতেই পারে। কিন্তু যদি-কিন্তু দিয়ে তো এমন মেগা ম্যাচ জেতা যায় না। বোলাররা বিপক্ষের উইকেট নিলেও, কাঁধ ঝুলে যাওয়া বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বারবার দেখা গেল। এরমধ্যে আবার গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো বিঁধছে সুদীপ ঘরামির (Sudip Gharami) কাঁধের চোট। তাঁর চোট এতটাই গুরুতর যে তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এবার ফর্মে থাকা ব্যাটারের কাঁধের হাড় সরে গেলে, বাংলার চিন্তা আরও বাড়বে। এমন করুণ পরিণতি দেখে বঙ্গ অধিনায়ক কিংবা হেড কোচ লক্ষ্মী রতন শুক্লা (Laxmi Ratan Shukla) পর্যন্ত জোর গলায় বলতে পারবেন না, ‘বাংলাই চ্যাম্পিয়ন হবে।’
প্রথম দিনের শেষে মনোজ দাবি করেছিলেন যে মাত্র ৮টা বলে বিপক্ষের নটে গাছ মুড়িয়ে দেবেন! তবে কথা ও কাজের মাঝে যেমন ফারাক, এক্ষেত্রেও তেমনই হল। হার্ভিক দেশাই (Harvik Desai) ৫০ রানে আউট হওয়ার আগে, বঙ্গ বোলারদের বুঝে নিলেন। শুধু হার্ভিকের কথা লিখলে ভুল হবে। নাইট ওয়াচম্যান নামা চেতন সাকারিয়া (Chetan Sakaria) ফেরার আগে খেলে গেলেন ৪৫টা বল! ভাবা যায়! সকালের ইডেনের সবুজে পিচ সবসময় ভয়ঙ্কর। মেগা ফাইনালের প্রথম দিনের প্রথম সেশনে বঙ্গ ব্যাটারদের অসহায় মাথা নত করা তো মিথ হয়ে গিয়েছে। সেই পিচেই নতুন বলের পালিশ তুলে দিলেন সাকারিয়া। তাই তাঁর ৭ রান নয়, সময় কাটিয়ে যাওয়াই বড় ফ্যাক্টর। তবুও এহেন নাইট ওয়াচম্যানকে আউট করে, ঈশান পোড়েল (Ishan Porel) এমনভাবে দুই কানে আঙুল দিয়ে সেলিব্রেশন করলেন, দেখে মনে হচ্ছিল তিনি যেন একাই বিপক্ষকে উড়িয়ে দেবেন!
চলতি মরসুমে ফাইনালের আগে লাগাতার দাপট দেখিয়েছিলেন আকাশ দীপ (Akash Deep)। তবে গত ফাইনালের মতো এবারও ফ্লপ তিনি। মুকেশ কুমার (Mukesh Kumar) জোড়া উইকেট নিলেন বটে, তবে সেই ঝাঁজ কোথায়! আর ঈশান, তিনি দুটি উইকেট নিলেও একেবারে প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ। মাত্র ছয় বছরের প্রথম শ্রেণির কেরিয়ারে দু’বার রঞ্জি ফাইনাল খেলার সুযোগ পেলেন ঈশান। কিন্তু এমন একটা সম্মানের ম্যাচে বাংলা দলের জার্সির মর্যাদাই দিতে পারলেন না।
আসলে যেমন বিরক্তিকর বঙ্গ ব্যাটিং, ঠিক তেমনই অসহ্যকর ‘ভারতসেরা’ পেস বোলিং লাইন আপ। মোক্ষম ম্যাচে বিপক্ষের টুঁটি চেপে ধরতে না পারলে কিসের ‘ভারতসেরা’! কম রানে হাতে নিয়েও যদি লড়াই করতে না পারে, আর কবে লড়বে! লাইন লেন্থের ঠিক নেই। একেবারে নেগেটিভ অ্যাপ্রোচ। সেটা যত না আকাশ-মুকেশের ক্ষেত্রে, এর চেয়ে অনেক বেশি মার খেলেন ঈশান। বাংলার রঞ্জি ফাইনালের ইতিহাসে ঈশান যেন সবচেয়ে জঘন্য বল করার নজির গড়ে গেলেন। তাঁর বোলিং ফিগার ১৭-২-৭২-২, ইকনমি ৪.০০।
আরও পড়ুন: Chetan Sharma Resigns: স্টিং অপারেশনের জের! ইস্তফা দিলেন মুখ্য জাতীয় নির্বাচক চেতন শর্মা
সেই সুযোগে পঞ্চম উইকেটে ৯৫ রান তুলে দিলেন শেল্ডন জ্যাকশন (Sheldon Jackson) ও অর্পিত ভাসাবাদা (Arpit Vasavada)। সেমিতে কর্নাটকের বিরুদ্ধে ২০২-এর পর দ্বিতীয় ইনিংসে প্রবল চাপের মুখে অপরাজিত ৪৭। শেল্ডন আবার সেই ম্যাচে ১৬০ করেছিলেন। তাঁর মারমুখী মেজাজের জন্যই খেলা থেকে হারিয়ে যায় ময়ঙ্ক আগরওয়ালের দল। এবার এহেন শেল্ডন ৫৯ রানে ফিরলেও, দল চাপে পড়েনি। কারণ বাকি সময়টা অনায়াসে খেলে দিলেন অর্পিত ও চিরাগ জানি। অর্পিত ১৫৫ বলে ৮১ রান ও চিরাগ ১০০ বলে ৫৭ রানে ক্রিজে রয়েছেন। ষষ্ঠ উইকেটে ১১৩ রানে পার্টনারশিপই বাংলাকে স্বপ্ন পূরণ করতে আরও দূরে ঠেলে দিল।
চিরাগ তখন ২৫ রানে ক্রিজে। চা পানের বিরতির পর সবে খেলা শুরু হয়েছে। সেই ওভারের শেষ বলটা মারতে গিয়ে ফাঁদে পা দেন ২৫ রানে ব্যাট করা চিরাগ। তাঁর হুক মিস হিট হয়ে চলে গিয়েছিল ফাইন লেগের দিকে। অনেক সময় পেয়েও লোপ্পা ক্যাচটা ছেড়ে দিলেন শাহবাজ। দলের সবচেয়ে ভালো ফিল্ডার এমন ক্যাচ ফস্কালে বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না যে, এই দলটা বছরের পর বছর ধরে ফাইনালে কোয়ালিফাই করতেই পারে। তবে সেই কাঙ্খিত রঞ্জি ট্রফি জেতার যোগ্যতা নেই।
তাই ইডেনের গ্যালারিতে থাকা প্রায় হাজার পাঁচেক ক্রিকেট পাগল যতই ‘জয় বাংলা’ বলে স্লোগান তুলুক, বিরাট মিরাকল না হলে এবারও কামব্যাক করা স্বপ্নই বটে। বিরাট কিছু মিরাকল না ঘটলে সৌরাষ্ট্র ফের একবার রঞ্জি ট্রফি হাতে তুলছে। সেই বাংলাকেই হারিয়ে। সেবার নিজেদের মাঠ রাজকোটে হারিয়েছিল। আর এবারের ভেন্যু ইডেন। পরিকল্পনাহীন ব্যাটিংয়ের পর এবার নিম্নমানের বোলিং, ঘরের মাঠে ফের অন্ধকারে ডুবল বঙ্গব্রিগেড। কলকাতার আকাশের মতোই।