মানস রায়, মালদা
বিএসএফের মর্জিতে নাকি পাখিও ওড়ে না সীমান্তে! ভোটের দিনেও সেই নিয়মের ব্যতিক্রম হল না কালিয়াচক ৩ নম্বর ব্লকে। প্রতিদিন সীমান্তের দরজা খোলে সকাল সাড়ে ছটায়। তাও দু’ঘন্টার জন্য। সারা দিনে মোট তিন বার। মঙ্গলবার ভোটের দিনেও সেই নিয়ম বজায় থাকল। সকালে কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে মূল ভূখণ্ডে এসে ভোট দিলেন একসময়ে জাল টাকার কারবারে কুখ্যাত হয়ে যাওয়া মহব্বতপুর, দুইশত বিঘি, হাদিনগর গ্রামের প্রায় পাঁচশো মানুষ। মালদা দক্ষিণ কেন্দ্রের এই গ্রামগুলো আসলে কাঁটাতারের বেড়ায় দুই টুকরো। এক টুকরো মূল ভারতে হলেও আরেক টুকরো যেন নিজদেশেই পরবাসী।মঙ্গলবার প্রথম দফায় সীমান্তের গেট খুলতেই ভোটার কার্ড আর বিএসএফের দেওয়া পরিচয় পত্র হাতে সীমান্তের গেট পেরিয়ে মূল ভারতে এসেছিলেন দুইশত বিঘি গ্রামের পারুল মণ্ডল, ত্রিপোলি সিংহ, মহব্বত পুরের মুন্নি খাতুন, ইসলাম শেখরা। তাঁরা ছুটলেন মহব্বতপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট দিতে। ফিরে এসে বিড়ি বাঁধতে বসলেন। না বাড়িতে নয়। বাড়ি যেতে ঢের দেরি। কাঁটাতার পেরিয়ে বিড়ি ওপারে যেতে দেওয়ার নিয়ম নেই যে। তাই সীমান্ত সড়কের গা-ঘেঁষে বিএসএফের করে দেওয়া একটা ঘরে বসে বিড়ি বাঁধলেন তাঁরা।

সাংবাদিক দেখে চুপি চুপি তাঁরা ক্ষোভ উগরে দিলেন বিএসএফের ‘বাড়াবাড়ি শাসন’ আর রাজনৈতিক নেতাদের ‘অবজ্ঞা’ নিয়ে। ইসলাম শেখ বলেন, ‘আমাদের জীবন চলে বিএসএফের ঘড়ি ধরে। যেটা জেলখানার চাইতেও কষ্টের। নিজের জমিতে কখন সার দেব, সেচ দেব সেটাও ওদের অনুমতি নিয়ে করতে হয়। এ ভাবে কি চাষাবাদ হয়। তাই জমি থাকলেও আবাদ করা হয় না।’

আনারুল হকের ক্ষোভ, ‘একটা সময়ে জাল টাকা, মাদকের চোরাকারবার বেড়েছিল। এখন সেটা কমলেও বদনাম যায়নি। নিজের আমবাগানে আম পড়ে থাকলেও কুড়োতে যেতে পারি না। বিএসএফ এসে বলে পাচারের লাইন করছিস।’ ত্রিপোলি বলেন, ‘মেয়ের বিয়েটা দিতে হয়েছিল এই পারে এসে এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে। এখন মেয়েটা সন্তাসম্ভবা। এই সময়ে অন্তত মাস তিনেক বাবার বাড়িতেই থাকাটা রেওয়াজ। কিন্তু অনুমতি মিলেছে সাত দিনের জন্য।’

কেন এত কড়াকড়ি? বিএসএফের এক কর্তা বলেন, ‘চাপে না রাখলেই ওদের সামলানো দায় হয়ে উঠবে যে।’ কাঁটাতারের ওপারের তিনটি গ্রামে প্রায় শ’পাঁচেক ভোটার। কিন্তু কোনও প্রার্থী ওদের কাছে ভোট চাইতে যাননি। একমাত্র তৃণমূলের স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য সুভাষ সিংহ একদিন গিয়ে তৃণমূলকে ভোটটা দিয়ে আসার কথা বলে গিয়েছিলেন। আর কোনও প্রার্থী তাঁদের ভূখণ্ডে পা রাখেননি। তবুও ওরা ভোট দিয়েছেন। কেন? ওঁরা বলেন, ‘এমনিতেই তো নেইরাজ্যে থাকি। জানি কেউ কিছু করবে না। তবুও ভোটটুকু দিই যাতে সম্পর্ক ছিন্ন না হয়। নইলে এনআরসি, সিএএ দিয়ে কবে যে ভারতীয় পরিচয়টুকুই হয়তো ছিন্ন করে দেবে।’ কথা বলতে বলতে ঘড়ি দেখেন ওঁরা। গেট খোলার সময় হয়ে গিয়েছে। ওঁদের হাঁটার গতি বাড়তে থাকে।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version