মাকড়সার রস। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত, ব্যোমকেশের সেরা কাহিনিগুলোর একটা। আর মাকড়সা রহস্য? মানে, পশ্চিমঘাট পর্বতমালার দক্ষিণ দিকে মাকড়সার নতুন রহস্য উন্মোচন? তাতেও এক বাঙালির কৃতিত্ব। তবে বাঙালি সাহিত্যিকের নয়, বাঙালি বিজ্ঞানীর। যাঁর নেতৃত্বে নতুন দুই শিকারি মাকড়সার সন্ধান পাওয়া গেল।শিকার বলে শিকার!
মৃদু কেঁপে উঠেছিল জালের একটা প্রান্ত। শিকার যে ধরা পড়েছে, সে বিষয়ে এক রকম নিশ্চিত হয়েই সে দিকে এগিয়েছিল বড়সড় মাকড়সাটা। কিন্তু একটু এগিয়েই তাকে থেমে যেতে হলো। আচমকাই তার উপর লাফ দিয়ে পড়ল আর এক জন। আর একটা মাকড়সা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রথম শিকারি মাকড়সার শরীরে বিঁধে যায় বিষাক্ত হুল।

কয়েক মুহূর্ত আগে যে ছিল শিকারি, সে-ই পরিণত হলো শিকারে। জাল পেতেই শিকার করে মাকড়সা। এ ক্ষেত্রেও জাল পাতার পর সেটা অল্প নড়ে উঠতেই মাকড়সা ভেবেছিল, শিকার ধরা পড়েছে। ভুল। সে বুঝতে পারেনি, তাকে শিকার করতে হানা দিয়েছে আরও খতরনাক এক শিকারি।

গত এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে পশ্চিমঘাট পর্বতমালার দক্ষিণ দিকে প্রায় অনাবিষ্কৃত জঙ্গলে সবার চোখের আড়ালে এমন হানাদারির ঘটনা ঘটে চলেছিল নিয়মিত। আরও অনেক বছর ধরে ব্যাপারটা হয়তো অজানাই থেকে যেত। কিন্তু পশ্চিমঘাট পর্বতমালার গভীর জঙ্গলের আড়ালে প্রকৃতির অন্দরমহলের রহস্য উদ্ঘাটন করতে উঁকি দিতে শুরু করেছিলেন জ়ুলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার (জ়েডএসআই) প্রাণিবিজ্ঞানীরা।

কলকাতায় সংস্থার সদর দপ্তরে গবেষণারত বাঙালি বিজ্ঞানী সৌভিক সেনের নেতৃত্বে প্রাণিবিজ্ঞানীদের একটি দল সম্প্রতি খোঁজ পেলেন মাকড়সার ‘মিমেটিডি’ পরিবারভুক্ত সম্পূর্ণ নতুন দু’টি প্রজাতির। আবিষ্কারকদের মধ্যে ছিলেন জ়েডএসআই কলকাতার সুধীন পিপি এবং কোচি-র সেক্রেড হার্ট কলেজের প্রদীপ এম শঙ্করণও।

জ়েডএসআই-এর সাম্প্রতিক এই আবিষ্কারের খবর ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে প্রাণিবিজ্ঞান সংক্রান্ত জার্নাল ‘জ়ুটাক্সা’-তে। জ়ুলজিস্টরা জানাচ্ছেন, ভারতে এতদিন ‘মিমেটিডি’ প্রজাতির একটি মাত্র স্পিসিসের মাকড়সার খবর পাওয়া গিয়েছিল। ১১৮ বছর আগে, ১৯০৬ সালে Iমিমেটাস ইন্ডিকাI প্রজাতির সেই মাকড়সার খোঁজ মেলে।

এতদিন পর পশ্চিমঘাট পর্বতমালায় ফের মিমেটিডি পরিবারেরই নতুন দু’টি স্পিসিসের মাকড়সার খোঁজ পেয়ে বিজ্ঞানীরা রীতিমতো উত্তেজিত। আবিষ্কারক দলের প্রধান সৌভিক সেন বলছেন, ‘নতুন দু’টি প্রজাতির নাম দেওয়া হয়েছে Iমিমেটাস স্পিনাটাসI এবং Iমিমেটাস পারভুলাসI। এই দুই স্পিসিসের মধ্যে প্রথমটি পাওয়া গিয়েছে কর্নাটকের মুকাম্বিকা ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারিতে এবং দ্বিতীয়টির খোঁজ মিলেছে কেরালার এর্নাকুলাম থেকে।’

জ়েডএসআই জানিয়েছে, Iমিমেটাস স্পিনাটাসI প্রজাতির মাকড়সাটি মাঝারি মাপের। এদের মাথা হালকা হলুদ এবং পেট ধূসর সাদা। তা ছাড়া, শরীরে হালকা সবুজ দাগ আছে। Iমিমেটাস পারভুলাসI-এর মাথা ফ্যাকাশে ক্রিম এবং তাতে ঘন সবুজ দাগ। এদের পেট তেকোণা এবং ধূসর সাদা।

মহিলা কর্মী, গবেষকদের জন্য সময়ের বেড়ি ZSI-তে

মিমেটিডি পরিবারের অন্য মাকড়সার মতোই এই দুই প্রজাতিও অত্যন্ত দক্ষ ও আগ্রাসী মানসিকতার শিকারি। শঙ্খচূড় সাপ যেমন অন্য সাপ শিকার করে, এরাও তেমন শিকার করে অন্য মাকড়সা। কখনও এরা অন্য মাকড়সার জালে ঢুকেও তাকে হত্যা করে। তবে বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, এই সব মাকড়সার বিষ মারাত্মক নয় মানুষের জন্য।

জ়ুলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অধিকর্তা ধৃতি বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘পশ্চিমঘাট পর্বতমালার বিভিন্ন অঞ্চল এখনও জীববৈচিত্র্যের বিরাট ভাণ্ডার। ১১৮ বছর পর এই জায়গায় মাকড়সার দু’টো সম্পূর্ণ নতুন প্রজাতির খোঁজ পাওয়া থেকেই প্রমাণিত হয় যে, ফিল্ড ওয়ার্কের কোনও বিকল্প নেই। আমাদের বিজ্ঞানীদের নতুন নতুন কাজ আগামী দিনে সবাইকে আরও অবাক করবে।’



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version